উপমহাদেশের ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ
- আপলোড সময় : ০৭-১১-২০২৫ ০৯:১১:৪৩ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-১১-২০২৫ ০৯:১১:৪৩ পূর্বাহ্ন
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
ভারত উপমহাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে এই অঞ্চলের কয়েকটি দেশের স¤পর্ক নতুন বাঁক নিয়েছে। এ ছাড়া ভারত উপমহাদেশে কয়েকটি দেশের ভূরাজনীতিও বদলে যাচ্ছে।
ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কে নতুন সমীকরণ :
ভারতের সঙ্গে অতীতে আফগানিস্তানের উষ্ণ স¤পর্ক ছিল। ১৯৫০ সালে স্বাক্ষরিত বন্ধুত্ব চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক শুরু হয়। সে সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে উন্নয়ন, শিক্ষা ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়তে থাকে। ভারত দীর্ঘ সময় ধরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত-সমর্থিত সরকারকে সমর্থনও দেয়। পরবর্তীতে ৯০ দশক থেকে আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান হতে থাকে। আর ২০২১ সালে দেশটিতে তালেবানরা সরকার গঠন করে। তালেবান সরকার গঠনের পর থেকেই আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের স¤পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। আর এই সময়ে বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানদের স¤পর্কের উন্নয়ন হতে থাকে। তবে এখন সময় বদলেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের স¤পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। আর এরই সুযোগ নিয়েছে ভারত।
২০২২ সাল থেকে ভারত তালেবান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক স¤পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা শুরু করে। ভারত এখন আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সর্বশেষ তালেবান প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানোর পর দুই দেশের সম্পর্কে বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। একই সঙ্গে মুম্বাই ও হায়দরাবাদে আফগান কনস্যুলেট চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে ভারত।
ভারত ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক জোরদার হওয়ার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এসেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে স¤পর্ক জোরদার হলে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাড়বে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিল। তবে সম্প্রতি উভয় পক্ষ সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এই সীমান্ত সংঘাত ঘিরে একে অপরের স¤পর্কে চূড়ান্ত অবনতি ঘটেছে।
তালেবান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে ভারত :
আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও চীনের প্রভাব রুখতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে ভারত। সে লক্ষ্যেই গত অক্টোবরে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে আমন্ত্রণ জানায় ভারত। আমির খান মুত্তাকি ভারতে এক সপ্তাহ সফর করেন। তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর এটিই ছিল তাদের সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির প্রথম ভারত সফর। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স¤পর্ক নিয়ে আলোচনা করা। ভারতের লক্ষ্য হলো আফগানিস্তানে তাদের দুই দশকের বিনিয়োগ রক্ষা করা। একই সঙ্গে প্রভাব বজায় রাখা। তবে তালেবান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক বজায় রাখলেও ভারত এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের একটি বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের এই স¤পর্কোন্নয়নের পেছনে একটি প্রধান কারণ হলো- পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাত এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিপরীতে আফগানিস্তানে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান জোরদার করা। ভারত সেই লক্ষ্যেই এগুচ্ছে।
বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান স¤পর্ক :
বিগত দেড় দশকে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ছিল উষ্ণ। বিশেষ করে সেই সময়ে দুই দেশের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে গতি আনেন। দুই দেশের সম্পর্ককে সোনালি অধ্যায় হিসেবেও বিবেচনা করে বাংলাদেশ ও ভারত। একই সময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর এই তিন দেশের স¤পর্কে নতুন সমীকরণ শুরু হয়। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে টানাপোড়েন শুরু হয়, আর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে গতি পায়।
বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে টানাপোড়েন বিদ্যমান। এসব ইস্যুর মধ্য রয়েছে- গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা, বাণিজ্য বিধিনিষেধ, পুশ-ইন, ভিসা বন্ধ, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি।
এদিকে একই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক প্রতিনিয়ত গভীর হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ছে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময় হয়েছে। দীর্ঘদিন পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার খান ঢাকা সফর করেছেন। এর আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ঢাকায় আসেন। সর্বশেষ পাকিস্তানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী আলী পারভেজ মালিক ঢাকা সফর করেন। বাংলাদেশ থেকেও সরকারের একাধিক প্রতিনিধিদল পাকিস্তান সফর করেছে। এসব সফর ও দুই দেশের বিভিন্ন পদক্ষেপ ভারতকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
নেপালের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় :
চলতি বছর সেপ্টেম্বরে নেপালি তরুণরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী কাঠমান্ডুর সংসদ ভবন অভিমুখে বিশাল মিছিল নিয়ে প্রতিবাদ করেন। টানা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ও প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউদেল পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে নেপালের প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর আগামী বছর ৫ মার্চ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশের আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মতোই নেপালেও একই ধরনের গণঅভ্যুত্থান ঘটে। সেখানেও বাংলাদেশের মতোই তরুণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। আর সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে সরকারের পতন হয়।
শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু :
দক্ষিণ এশিয়ায় তিনটি দেশে সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। তবে এর শুরুটা হয়েছিলো শ্রীলঙ্কা থেকে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থান হয়। সেই অভ্যুত্থানের পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা, তীব্র মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক সঙ্কট, বিদ্যুৎবিভ্রাট, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঘাটতির কারণে হয়েছিল সেই অভ্যুত্থান। শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বেশির ভাগই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সাধারণ জনগণের স¤পৃক্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কার ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন বামপন্থি দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক। তিনি শ্রীলঙ্কায় বামপন্থি নেতা হিসেবে সুপরিচিত। তবে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েক ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। একই সঙ্গে দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
কোন পথে মালদ্বীপ :
২০২৩ সালে মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মুইজ্জু। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের টানাপোড়েন শুরু হয়। তবে মালদ্বীপের রাজনীতিতে বরাবরই ভারতের প্রভাব ছিল। দেশটির অতীতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টরা ভারত সফরের মধ্যে দিয়েই প্রথম বিদেশ সফর শুরু করতেন। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মোহাম্মদ মুইজ্জুর প্রথম বিদেশ সফর ছিল তুরস্ক। আর তুরস্ক থেকে তিনি চীন সফর করেন। প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু প্রথম দিকে অনেকটা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। অবশ্য পরবর্তীতে গত বছর দিল্লি সফর করেন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু। ভারত ও চীন উভয়ের দিকেই তিনি ভারসাম্য রক্ষার নীতি গ্রহণ করেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ লক্ষ্যে গত বছর দিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষাসচিব গিরিধর আরামানে ও মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ইব্রাহিম হিলমি বৈঠক করেন। সেখানে উভয় দেশ প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়াতে একমত হয়।
যেভাবে চলছে ভুটান :
ভারত ও চীনের প্রতিবেশী দেশ ভুটান। সে কারণে এই দুই বৃহৎ শক্তি ভুটানে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তবে ঐতিহাসিকভাবেই ভুটানের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে আসছে ভারত।
চীনের সাথে ভুটানের দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত বিরোধ চলছে। তবে সম্প্রতি ভুটান ও চীন সীমান্ত বিরোধ নিরসনের চেষ্টা করছে। এই লক্ষ্যে দুই দেশ একটি সীমান্ত সহযোগিতা চুক্তিও সই করেছে। এ উদ্যোগ সফল হলে চীনের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্ক আরও বাড়বে। এদিকে চীন ও ভুটানের মধ্যে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, তবে দুই দেশ সব সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। বর্তমানে চীন ও ভারতের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষার নীতি গ্রহণ করেছে ভুটান। দুই দেশের সাথে এই ভারসাম্য রক্ষা করাটাই ভুটানের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

সুনামকন্ঠ ডেস্ক